
সাবানের ফেনায় হারিয়ে যায় আঙ্গুলগুলো, যেন মেঘের ভেতরে পাখা ঝাপটায় কোন অস্থির পাখি। লাবণীর মনটাও ভীষণ অস্থির। টুম্পার সম্ভবত করোনা হয়েছে। তবু হাসপাতাল থেকে বাসায় থাকতে বলেছে। কেন, কিচ্ছু বুঝতে পারছি না! খুব ভালো করে হাত ধুয়ে নেয় লাবনী। নতুন একটি মাস্ক পরে। স্যুপের বাটি চামিচ নিয়ে এক ফালি লেবু কাটে। হাড়ি থেকে বাটিতে স্যুপ ঢালে। ডাক্তার বল্লেন, বাসায় বাচ্চার যত্ন নিন আর নিজেরা সাবধানে থাকুন। কি কথা! আরে বড়’রা না হয় সাবধানে থাকলো। ছোট বাচ্চা সাবধানে থাকা বোঝ? স্যুপের মধ্যে লেবুটা চিপে দেয় । একটি প্লেটের মধ্যে বাটিটা তুলে নিয়ে কিচেন থেকে বের হয় লাবণী। ডাইনিং স্পেস পাড় হয়ে টুম্পার বেডরুমের দরজায় এসে দাঁড়ায়। মেয়ের উপড় কতটা মানসিক চাপ পড়ছে। নয় বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে কতক্ষণ একা থাকতে পারে! আমিই বা কতক্ষণ সময় দেব। বেডরুমের তালা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে লাবণী। লাবণীকে দেখেই টুম্পা বিছানায় উঠে বসে। চোখ মুখ বিকৃত করে চিৎকার করে –
তুমি আবার এসেছো ! তোমাকে না বলেছি আমার কাছে আসবে না।
আমি এক্ষুণি চলে যাব। তুমি স্যুপটা খেয়ে নাও।
খাব না আমি তোমার স্যুপ!
টুম্পা ছুটে এসে স্যুপের বাটি নিয়ে জানালার দিকে ছুড়ে দেয়। লাবণী যেন পাগল হয়ে যাবে।
কি করলে তুমি! কি করলে! নীচে রাস্তায় কারো মাথায় পড়লে?
কারো মাথায় পড়বে না। এখন তো কেউ রাস্তায় হাঁটেই না।
মা প্লিজ, একটু ভালো হয়ে থাকো!
তুমি ভালো হয়ে যাও! তুমি কেন বাবার সাথে আমাকে দেখা করতে দাও না! তুমিই তো খারাপ! তুমি শয়তান!
বুকটা জ্বলে যায় লাবণীর। চোখ ফেটে কান্না আসে। কি করে বোঝাবো টুম্পা তোকে সত্যিই আমি ভালোবাসি।
কলিং বেল বাজে। টুম্পা দৌড়ে বের হতে যায়। লাবণী সবল হাতে ওকে আটকায়। টুম্পা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। দুজনের ধস্তাধস্তি শুরু হয়। মৃদু ধাক্কায় দুর্বল টুম্পা মেঝেতে পড়ে যায়। সেই সুযোগে লাবণী বের হয়ে আসে। তালা দেয়। টুম্পা চিৎকার করেই চলেছে। লাবণী দৌড়ে এসে দরজা খুলে দেয়। টুটুল দাড়িয়ে আছে দরজায়। এক হাতে ভারি বাজারের ব্যাগ অন্য হাতে ছোট্র একটি প্যাকেট তাতে নানান চকলোট। টুটুল দেখে লাবণী কি আপ্রাণ চেষ্টা করছে কান্না থামাবার।
কি হয়েছে লাবণী?
তুমি একটু দাঁড়াও। আমি স্যাভলন পানিটা নিয়ে আসি। হাত পা ধুয়ে ভেতরে আসো।
লাবণী ওয়াশরুমে গিয়ে আগে থেকেই মিক্স করে রাখা স্যাভলন পানি নিয়ে আসে। কি জবাব দেব টুটুল! কিভাবে তোমাকে বলবো তোমার মেয়েকে এইমাত্র আমি ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছি। লাবণী স্যাভলন পানির গামলাটা দরজার সামনে রেখে টুটুলের হাতের ব্যাগ দুটি নেয়। টুম্পা তখনও ভেতর থেকে লাবণীকে গালাগাল করছে। টুটুলের খুব বিষণ্ণ লাগে। মেয়েটা কেন বোঝে না! লাবনী এত করে –
কি ভাবো? পা ধোও! আমি বাজারটা ধুয়ে তুলি।
টুম্পা খেপেছে কেন?
স্যুপ দিয়েছি খাবে না।
বণী, ওকে একটু দেখে আসি ?
তুমিও কি মেয়ের মতন অবুঝ হলে? জান না কাছে গেলেই ও তোমাকে জড়িয়ে ধরবে?
ধরুক না, গোসল তো করবোই। মুখে তো মাস্ক পরাই থাকবে। চশমাও পরা আছে। ওর কাছ থেকে বের হয়েই গোসল করে ফেলবো। হবে না? যাই?
জানি না!
প্লিজ! তুমি না করলে যাবো না…
আচ্ছা যাও। একটু দূরে থাকার চেষ্টা কর।
অবশ্যই তোমার চিন্তা আছে না আমার।
অমি বোধহয় আমার জন্য ভাবি?
আমি তা বলিনি। তবু, আমার সারাক্ষণ চিন্তা হয় তোমাকে নিয়ে। তুমি তো –
আমার কিছু হবে না। আমি খুব সতর্ক
লাবণী তালা খুলে দেয়। টুম্পা বলে দেবে না তো ওর বাবাকে… টুটুল কি বুঝবে আমাকে… টুটুলকে দেখেই টুম্পা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে।
তুমি ভেতরে আসবে না!
টুম্পা দরজা লাগিয়ে দেয়। লাবণী কিচেনে এসে বাজারের ব্যাগ খুলে প্রতিটি জিনিস সাবান পানিতে ধোয়। চকলেটগুলো আগে দিয়ে আসবো? না কি আমাকে দেখলে আবার রেগে যাবে… নাহ দিয়েই আসি। খুশি হবে মেয়েটা। লাবণী চকলেটগুলো ভালো করে ধুয়ে পেপার ন্যাপকিন দিয়ে মুছে টুম্পার রুমের সামনে এসে আটকে যায়। টুটুল একান্তে কথা বলছে মেযের সাথে।
বাবাও যদি মার মতন মরে যায় তখন কেমন হবে বলো তো?
না তুমি মরবে না!
লাবণী তো সেই চেষ্টাই করছে। টিভিতে দেখনি, যাদের ডায়েবেটিস আছে, হার্টে অসুখ আছে, তাদের করোনার ঝুঁকি বেশি? ধর তুমি তো আমার সুপার গার্ল !
করোনায় তোমার কিছু হবে না। কিন্তু আমি তো সুপার ম্যান না। তোমার থেকে করোনা হয়ে আমি যদি মরে যাই পরে একা একা তোমার ভালো লাগবে?
না তুমি মরবে না!
টুম্পা কাঁদতে শুরু করে। লোকটা কি পাগল! লাবণী আর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে।
তুমি কি বল তো… বাচ্চার সাথে কেউ এভাবে কথা বলে। টুম্পা কাঁদে না মা। দেখ বাবা কত চকলেট এনেছে তোমার জন্য!
লাবণী আমাদের একটু একা ছাড়বে? আর একটু কথা আছে আমার মায়ের সাথে।
টুটুল লাবণীর হাত থেকে চকলেটগুলো নিয়ে লাবণীকে বাইরে যেতে ইঙ্গিত করে। লাবণী বের হয়। কিন্তু দরজার এ পাশ থেকে পা নড়ে না। টুটুল মেয়েকে কাছে টেনে নেয়। চোখের জল মুছে দেয়।
তো জানো না আম্মু, তোমার মা মারা যাবার পর, তোমার তখন চার বছর বয়স। একবার ভীষণ অসুখ করে তোমার। ডাক্তাররা ভেবেছিলেন তুমি বাঁচবে না।
আমার মনে হচ্ছিল তোমার কিছু হলে আমিও বাঁচবো না। কিতু একজন মমতাময়ী নার্স তোমাকে ভীষণ সেবা যত্ন করে বাঁচিয়ে তুল্লেন। সে কে তুমি জান?
কে?
তোমার লাবণী মা।
ও!
লাবণী তোমাকে খুব ভালোবাসেন। এখন কি তুমি সব বুঝতে পারছো আমার লক্ষ্ণী সোনা? আমি এখন যাই? তুমি চকলেট খাও। কেমন?
এতক্ষণে টুম্পা যেন শান্ত হলো। সে মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানায়। টুটুল রুম থেকে বের হতেই লাবণীর সামনে পরে।
ওকে কেন এত কথা বললে?
কিছু কথা না জানানোটা পাপ।
কোন দরকার ছিলো না। যাও তুমি গোসল কর আমি ভাত দিচ্ছি।
টুটুল মাস্টার বেডরুমে চলে যায়। লাবণী বাজারগুলো ফ্রিজে তুলে রাখে। প্রচুর ফেনা করে কুনুই পর্যন্ত হাত ধোয়। মাস্ক খুলে ফেলে। মেয়েটা দুপুর বেলা চকলেট খাচ্ছে! টুটুল বললে যদি একটু ভাত খায়। মুখ ধুয়ে লাবণী টেবিলে খাবার সাজায়। আজকের দিনে বাসায় কোন গেস্ট নেই। কি মহামারী এলো। বিরক্তিতে লাবণীর ভ্র কুঁচকে ওঠে।গোসল সেরে টুটুল আসে।
কি হয়েছে?
কি হবে?
ভ্রূ কুঁচকে রেখেছো কেন?
ও। ভাবছিলাম করোনার কথা। কেমন একটা বৈশাখ কাটাচ্ছি বল? টুম্পা কত খুশি হয় শাড়ি পড়লে..
হুম।
আচ্ছা শোন, আমার একটা শাড়ি কেটে টুম্পাকে শাড়ি ব্লাউজ করে দেই?
পাগলামী কর না। পড়বে না, পরে তোমার মন খারাপ হবে।
সে আমি বুঝবো। তুমি ভাত খাও।
মানে কি তুমি এখন খাবে না?
এক্ষুণি আসছি। আমি একটু শাড়িটা সিলেক্ট করে আসি। তুমি একটু শর্ষে-সজনে খেতে থাকো, আমি আসছি।
পাগল!

লাবণী বিছানায় বসে হাতে লাল টুকটুকে ব্লাউজ সেলাই করছে। টুটুল আধসোয়া হয়ে টিভি দেখছে। হঠাৎ টুম্পা দরজায় এসে দাঁড়ায়। তার দুটি হাত পেছনে জড়ো করে রাখা। লাবণীর চোখে পড়বার জন্য অপেক্ষা করে সে। লাবণী তাকায়।
আমি যদি তোমাকে কিছু দেই তাতেও কি করোনা চলে যাবে?
না ..কি.. কেন?
লাবণীর বুকের মধ্যে যেন শত করতাল বেজে ওঠে। টুম্পা আমাকে কিছু দেবে! কি দেবে! টুম্পা ছোট ছোট পা ফেলে লাবণীর কাছে আসে। সামাজিক দুরত্ব রেখে দাঁড়ায়। পেছনে লুকিয়ে রাখা হাত এবার সামনে আনে। ওমা আমার জন্য গিফট! স্কুলের খাতার পৃষ্ঠা দিয়ে বানানো একটি প্যাকেট। টুম্পা কোন সম্মোধন ছাড়াই প্যাকেটটি লাবণীর দিকে বাড়িয়ে দেয়। লাবণী টুটুলের দিকে তাকায়। কি জাদু করলে তুমি মেয়েকে? প্যাকেট খুলেলে ভেতর থেকে রেব হয় কয়েকটি অনুপম কাগজের চুড়ি। তাতে প্যাস্টেল আর গ্লিটার দিয়ে ডিজাইন করা। সাথে একটি হাতে বানানো কার্ড । কার্ডে লিখা “লাবণী মা, শুভ নববর্ষ!” আনন্দে লাবণীর যেন শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে। সে ছুটে এসে টুম্পাকে জড়িয়ে ধরে। আষ্ঠে পৃষ্ঠে চুমু খায়… টুটুল আঁতকে ওঠে।
এই লাবণী তুমি কি করছো!
এখন আমি মরে গেলেও আমার আর কোন দুঃখ নাই টুটুল!
লাবণী ফুলে ফুলে কাঁদে। যেন অনন্ত দিনের কান্না কষ্ট জমে ছিলো। আজ টুম্পার স্বীকৃতিতে সব বৈশাখি ঝড় হয়ে নামে।
পড়লাম,বন্ধু। দারুণ হয়েছে।
অনেক ধন্যবাদ বন্ধু। শুভেচ্ছা।
[…] আরো পড়তে পারেন: শুভ নববর্ষ […]
[…] করোনাকালের আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন : করোনাকাল-১ : শুভ নববর্ষ […]