
উর্মি শাহানা বেগমের প্লেটে পাহাড়ের মতন উঁচু করে ভাত দেয়। শিহাব হা হয়ে যায়।
কি করছ উর্মি? এতগুলো ভাত দিদু খেতে পারবেন? এতগুলো করে ভাত তো যাকেই দেবে সেই নষ্ট করবে।
চুপ কর, দিদিমা আসছেন!
না না, তোমার সমস্যা কি? ভাত ছাড়লে সেটা নিয়ে তুমিই তো আবার কথা শোনাবে…
চুপ কর না! প্লিজ! দিদিমা খেতে আসেন। আসেন। বসেন।
শিহাবের কষ্ট হয় নিজেকে শান্ত করতে। চুপচাপ কোনমতে ভাত খায়। আজ উর্মির সাথে কথা বলতেই হবে। ওকি পারভারটেড হয়ে উঠছে না কি? ও কি দিদুকে বকাঝকা করে ওর লকডাউন কালিন অবসাদ দূর করছে.. মাথার ভেতরে উর্মির প্রতি আক্রোশ থামাতে পারে না শিহাব।
অবশ্য প্লেটে অতগুলো ভাত দেখে শাহানা বেগেমের মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আড় চোখে সে খুশি উপভোগ করে উর্মি।
উর্মি ঘরে আসতেই দরজা লাগায় শিহাব। তার চোখ মুখ কঠিন।
কি হয়েছে? চেহারা কদবেলের মত বানিয়ে রেখেছ কেন?
বস।
বসলাম। কি হয়েছে? এত সিরিয়াস কেন?
উর্মি, দেখ এখন সময়টা এমন যে আমরা সবাই আপসেট। বোরড। কাল তোমার খালা মারা গেছেন আজ আমার ফুপু মারা যেতে পারেন। আমরাও যে কোনদিন নাই হয়ে যেতে পারি। তাই না?
পারি।
তুমি দিদুর সাথে যা করছো সেটা ঠিক না।
কি করছি আমি?
তুমি সেটা পরিষ্কার জান, তুমি দিদুর সাথে কি করছো, আমি শুধু জানতে চাচ্ছি তুমি এসব কেন করছ?
আমি যা করছি দিদিমার ভালোর জন্য করছি। আমাকে ভালো করে জিজ্ঞেস করলে জবাব দিতাম এখন আর দিতে ইচ্ছে করছে না।
কি ভাল? পঁচাশি বছরের বৃদ্ধাকে তুমি প্রতি বেলায় খাবার নষ্ট করবার জন্য বকাঝকা করছ। আবার নিজেই ইচ্ছে করে প্লেটে বেশি খাবার তুলে দিচ্ছ, যাতে উনি নষ্ট করেন? এর মানে কি? মজা নিচ্ছো আমার দিদুর সাথে?
শিহাব কি বলছ এসব, তুমি আমার সাথে কিভাবে কথা বলছ?
কিভাবে বলব বল? আসলে তোমার পার্লার, শপিং, বুটিকস এসব বন্ধ তো সেজন্য তুমি সিক হয়ে যাচ্ছো। লুক আই এ্যাম অলছো ফিলিং বোরড, ফিলিং স্ট্রেসট, উই অল আর গয়িং থ্রু দ্য সিচ্যুয়েশন…
য়্যু আর সিক শিহাব।
অপমানে উর্মির মুখ লাল হয়ে ওঠে। কিন্তু সে নিজেকে সামলে নেয়।
শিহাব, চল একটু ছাদে যাই।
আমার এখন ছাদ-বিহারের মুড নাই।
চল। তোমাকে কিছু একটা দেখাব। চল। চল।

উর্মি শিহাবের হাত ধরে টেনে নিয়ে ছাদে আসে। ছাদে উঠতেই শিহাব যেন খানিকটা বুঝতে পারে উর্মিকে।
শাহানা বেগম একঝাক কাক খাওয়াচ্ছেন। তাঁর অবয়বে স্বর্গের আলো। শিহাব কিছু বলবে বুঝতেই উর্মি ইশারায় চুপ হতে বলে। দিদু ওদের দেখে যেন কৈফিয়ত দেয়।
কতগুলো ভাত এঁটো হয়ে গেছিল। ভাবলাম ফেলে দিয়ে কি হবে, পাখিগুলিকে খাওয়াচ্ছি…
ঠিক আছে। কিন্তু এভাবে আর ভাত নষ্ট করবেন না। ভাত নষ্ট হলে আমার খুব খারাপ লাগে। খুব রাগ লাগে দিদিমা! আপনি জানেন না, প্রতিদিন খবরে দেখছেন না কত মানুষ খেতে পায় না। এই করোনায় যত না মানুষ মরবে তার চেয়ে বেশি মানুষ মরবে না খেয়ে। এখন যান নিচে গিয়ে একটু রেস্ট নেন।
শাহানা বেগম উর্মির বিরক্তি দেখে খুব বিব্রত হন। মুখটা শুকিয়ে এতটুকুন হয়ে যায়। বাধ্য মেয়ের মতন ছোট ছোট পা ফেলে নিচে নেমে যান।
শিহাব অনেক কষ্টে নিজেকে চুপ রেখেছিল। এবার যেন ফেটে পড়ে-
তুমি বৃদ্ধা মানুষটার মুখটা একবার দেখেছিলে? দেখেছিলে কি রকম কাল হয়ে গেছিলো অপরাধবোধে?
এখন একটু নিচে গিয়ে দেখে এস দিদিমাকে কেমন দেখাচ্ছে। যাও, দেখে আসো না। যাও না। আমি আছি এখানে। তুমি কিছু বলবে না। শুধু দেখে চলে আসবে।
শিহাব কোন কিছু না বুঝেও উর্মির কথা মতন দিদিমার ঘরে আসে।
দিদিমা রকিং চেয়ারে বসে জোরে জোরে দুলছেন। চেহারায় কৈশরীয় কৌতুক, মুখে গান:
আইলারে নয়া দামান আসমানেরও তাঁরা
বিছানা পাইত্যা দিমু শালি ধানের নাড়া
দামান বও দামান বও…
আপন আনন্দে বিভোর দিদিমা শিহাবকে দেখতে পান না। দিদিমার আনন্দ শিহাবের মুখে হাসি হয়ে ফোটে। মুখ ভর্তি হাসি নিয়েই সে ছাদে আসে।
উর্মি কি হচ্ছে কি বলতো? দিদু এত খুশি কেন?
খুশি হবেন না, এইমাত্র তোমার বিদ্যান স্মার্ট বউকে বোকা বানিয়ে গেলেন, খুশি হবেন না?
মানে কি? কিছু না বুঝেও শিহাবের হাসি আকর্ণ হয়। উর্মি এবার মোড়ক খোলে।
শোন, প্রথম প্রথম আমি সত্যিই দিদিমার উপড় রাগ হতাম। হঠাৎ দিদিমা এত ভাত নষ্ট করেন কেন! ভাবতাম ভাতটা অল্প অল্প করে নিলেই হয়। একবারে বেশি নিয়ে প্রতি বেলায় নষ্ট করেন কেন? পরে আমার নাখোশ চেহারা দেখেই সম্ভবত দিদিমা নিজের প্রয়েজনের ভাতটুকুই পাতে নিতেন, কিন্তু খেতেন সেটারও অর্ধেকটাই। অর্থাৎ তিনি অর্ধাহারে দিন কাটাতে শুরু করেন। দু তিন দিন দেখার পর আমার কেমন খটকা লাগে। আগে দুপুরে খাবার পর সবসময়ই উনি একটু বিছানায় যেতেন। লক ডাউনের পর থেকেই দেখি দিদিমা বিছানায় না গিয়ে ছাদে যান। একদিন ওনার পেছন পেছন ছাদে এসে দেখি এই দৃশ্য।
ও, তাই! তাহলে তুমি দিদুকে বলতে- দিদু কোন সমস্যা নাই আপনি পাখিকে খাওয়ান, কুকুর বেড়াল খাওয়ান যা লাগে বলেন…
প্রথমে আমারও তাই মনে হয়েছিল। কিন্তু শিহাব, তাতে ওনার ত্যাগের আনন্দটা উনি কোথায় পেতেন, বলতো?
শিহাব গাছের ডালে, কার্নিশে পাখিগুলোকে দেখে। কেও শান্ত, কেও কোলাহল মুখর। কে জানে হয়তো দিদুর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে!
[…] করোনাকালের আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন : করোনাকাল ৫: দিদিমা […]