
[হাতী মানুষের উপকার করে। উপকার পেলে কৃতজ্ঞতা জানায়। সুযোগ থাকলে প্রতিদানও দেয়। এটি একটি প্রতিদানের গল্প]
এক রাজার হাতীশালে একদিন একটি হাতী এক অজানা কারণে ভীষণ কাতর হয়ে পড়ে। দুদিনের মধ্যে হাতীটির অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটে। প্রথম দিকে মাহুত- যে কিনা হাতীদের দেখভাল করে, কাছ থেকে বিষয়টি পরখ করার চেষ্ট করে। কিন্তু সে কিছুতেই কিছু বুঝে উঠতে পারে না।
সময় গড়াবার সাথে সাথে বোঝা যায় হাতীটির যন্ত্রণা তির তির করে বেড়েই চলেছে।
মাহুতের লাগাতর ব্যর্থতায় প্রথমে হাতীটি ক্ষুব্ধ ও পরে ক্রুব্ধ আচরণ করতে শুরু করে। ফলে মাহুতের পক্ষে নতুন করে তার নীরিক্ষা বা চিকিৎসার আর কোনো উদ্যোগ নেয়া সম্ভব হয় না। হতাশ মাহুত বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মহারাজার বরাবরে খবর পাঠিয়ে দেয়।
সন্ধ্যা নাগাদ হাতীটি এক পা উঁচিয়ে করুণ সুরে আর্তনাদ শুরু করে। । ক্রমে হাতীশালের সুস্থ ও সমব্যথী হাতীরা তার আর্তনাদের সুরে সুর মেলায়। সমবেত বৃংহতি রবে রাত্রির নিস্তব্ধ নীরবতা বারম্বার চূর্ণবিচূর্ণ হতে থাকে।

রাজা স্বয়ং বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। যোগ্যতর হস্তীবৈদ্যের খোঁজে তিনি চারদিকে লোক পাঠিয়ে দেন।
রাজবাড়ির কাছেই ঝিলের ধারে হাতীদের স্নান ও জল খাবারের ঘাট। ঘাটের ঠিক উপরে বাস করত রাজার ক্ষৌরকার অর্থাৎ নাপিত ও তার পরিবার। আশেপাশের অন্যান্য পরিবারের মত এই পরিবারটিও গগনবিদারী বৃংহতি রবের কারণে ঘুমাতে পারছিল না। মধ্যরাতের পর হাতীদের উচ্চ আহাজারি খানিকটা কমে এলে ক্ষৌরকারের চোখ মুদে আসে। সে প্রাণপণে ঘুমুবার চেষ্টা করে। ভোরেই তাকে ছুটতে হবে রাজবাড়িতে। সে চুলদাড়ি কামিয়ে দিলেই না কেবল রাজা প্রস্তুত হয়ে দরবারে যেতে পারবেন। কাল যে রাজাকে বেশ সকাল সকালই দরবারে বসতে হবে তা সে ভালই বুঝতে পারছে।
খানিকক্ষণ সে ঘুমিয়েছে কি ঘুমায় নি। জোড়ালো হুড়মুড় শব্দে সচেতন হয়ে ওঠে। ধড়ফড় করে উঠে বসে সে বিছানার উপর। বোঝবার চেষ্টা করে কি ঘটেছে বা ঘটছে। তখনো একটা সরসর শব্দ পাচ্ছিল সে পইথান অর্থাৎ পায়ের দিক থেকে।
নিজেকে সামলে নিয়ে, উঠে বাতি জ্বালাল সে।
সন্তর্পণে পায়ের কাছটাতে আলো ফেলতেই যা দেখতে পায়, তাতে সে হতভম্ব হয়ে পড়ে।
কি এটা? গাছ?
নাহ্।
নড়ছে তো।
তবে কী? বিশাল অজগর?
ভয়ে পেয়ে এক পা পিছিয়ে যায় ক্ষৌরকার। এদিকে ওদিকে তাকায়। কিছু খুঁজে পেতে চায় সে নিজেকে রক্ষা করবার জন্য। তেমন কিছু নজরে আসে না বলে অসহায় ক্ষৌরকার সাহস সঞ্চয় করবার চেষ্টা করে। আলো উঁচিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে সে। বিরবির করে বলে, ’হাতীর পা?’
ধীরে ধীরে এগোয় সে। হ্যা, তাই তো।
ক্ষৌরকার এবার ঘটনা বিশ্লেষণে মনোযোগ দেয়। এই পা’টি তবে সেই যন্ত্রণা কাতর হাতীটির। তার অর্থ পায়েই তার কিছু হয়েছে। এবং কোনোভাবে তার মনে হয়েছে যে, ক্ষৌরকার এই সমস্যার সমাধান করতে পারবে। তাই তার কুড়ে ঘরের বেড়া ভেঙে সে পা ঢুকিয়ে দিয়েছে।
বেড়ার চিন্তায় উদ্বিগ্ন হলেও আপাততঃ সে হাতীর পায়ে গভীর মনোযোগ দেয়। কোথাও কি আঘাত পাওয়া সম্ভব? মনে হয়, না। তবে কি পায়ের তলায় কাঁটা বিঁধেছে? আলো উঁচিয়ে উঁচিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে সে। আলতো হাতে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে হাতীর নরম পায়ের তলা।
একটা জায়গা মনে হয় বেশ ফোলা। একটা ক্ষত চিহ্নও আছে, তবে খুব ছোট। আঙুলে টিপে দেখে সে। যন্ত্রণায় কেঁপে ওঠে হাতীর পা। বুদ্ধিমান নাপিত নীরিক্ষার উপসংহার টানে।
নাপিত নিশ্চিত হয় যে, পায়ের এ স্থানটিতে কাঁটা বা কিছু বিঁধেছে এবং ওজনের চাপে ধীরে ধীরে তা হাতীর পায়ের তলার মোটা ও নরম ত্বক ভেদ করে ভেতরে ঢুকে গেছে।
সে বুঝতে পারে এর প্রথম চিকিৎসা হল শৈলকর্ম।
অভিজ্ঞ নাপিত স্থানটি অসাড় করতে প্রথমে আফিম গোলা জল দিয়ে ধুয়ে আফিম পট্টি লাগিয়ে রাখে। তারপর সে ধারালো ক্ষুর দিয়ে ক্ষত স্থানটির মাঝ বরাবর কেটে ফেলে। এবার সে দুপাশের মাংসে জোরে চাপ দেয়। তাতে করে প্রথমে পুঁজ ও পরে পুঁজের সাথে ভুস করে একটি বেশ বড় আকারের বড়ইয়ে বিচি বেরিয়ে আসে।
শৈলকর্ম শেষে হলুদ বাটা মাখিয়ে মোটা কাপড়ে ভাল করে বেঁধে দেয় শৈলকার।
এবার সে সন্তুষ্ট চিত্তে হাতের চাপড়ে ইশারা করতেই হাতীটি পা টেনে নেয়। কিছুক্ষণ পর ক্ষৌরকার টের পায় হাতীটি উঠে দাঁড়িয়েছে।
তখন রাত পোহাবার আর বেশি দেরি নেই। ঘুমুবার সময় একেবারেই নেই। তবে একটু জিরিয়ে নিতে পারলে মন্দ হয় না। এই ভেবে সে বিছানায় গা এলায়।
সকালে বাইরের হৈ হট্টগোলে তার ঘুম ভাঙে। মনে হচ্ছে পাইক পেয়াদার কণ্ঠস্বর।
আজ বুঝি চাকরিটাই গেল তার।
পড়িমরি করে সে বিছানা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে।
বাইরে তখন এলাহি কাণ্ড চলছে।
রাজার শষ্যভাণ্ডার ভেঙে হাতীরা সব শষ্যাদি নাপিতের বাড়ির আঙিনায় স্তুপ করছে। রাজার লোকেরা বাধা দিলে বা শষ্য সরাতে এলে হাতীরা দলবেঁধে তেড়ে আসছে।
রাজা কাছে জরুরী খবর পাঠানো হল।
সব শুনে রাজা স্থানান্তরিত শষ্যাদি সব সেখানেই আপাতত সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে বললেন। আর ঘোষণা করলেন ভাল কাজের জন্য অবশ্যই ক্ষৌরকারকে যথোপযুক্ত পুরষ্কার ও সম্মান দেয়া হবে।